Wednesday, February 16, 2011

বিশ্বকাপের উদ্বোধন কাল


বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বর্ণাঢ্য আয়োজন

০০ স্পোর্টস রিপোর্টার

অবশেষে চার বছরের সকল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আগামীকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে উদ্বোধন ঘটতে যাচ্ছে ঐতিহাসিক ১০ম বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরের। সুর, আলোর বর্ণিল ছটা ও আতশবাজির রোশনাইয়ে দক্ষিণ এশিয়ার তিন আয়োজক দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলার পর বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ এই ক্রীড়া আসরের খেলাগুলো মাঠে গড়াবে রবিবার থেকে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল বিকালে এই প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করবেন। সে সময় তার সাথে থাকবেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) সভাপতি শারদ পাওয়ার ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি ও অর্থ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মোস্তফা কামাল এমপি। তারা স্বাগত ও শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা শেষে ভিভিআইপিতে স্থাপিত অত্যাধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিশ্বকাপ-২০১১-এর উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। এ সময় স্টেডিয়ামের পূর্বপাশের শিল্প ব্যাংক ভবনে টানানো বিশাল পর্দায় বিশ্বকাপের প্রতিকৃতি ভেসে উঠবে। একই সাথে শান্তির প্রতীক কপোতের দল ডানা মেলে আকাশে উড়ে যাবে। বাংলাদেশ এই প্রথম কোন খেলার বিশ্বকাপ আয়োজন করার সুবাদে বিরল এক ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে। টুর্নামেন্টের প্রথম খেলায় বাংলাদেশ ও অতিথি ভারত মুখোমুখি হবে। প্রতিযোগিতার সহআয়োজক ভারত অবশ্য বিগত বিশ্বকাপের তিক্ত অভিজ্ঞতা মাথায় রেখেই বাংলাদেশকে মোকাবিলা করবে। ক্যারিবীয় সাগর পারে চার বছর আগে অনুষ্ঠিত ওই বিশ্বকাপে এই বাংলাদেশের কাছে হেরেই প্রতিযোগিতার প্রথম রাউন্ড থেকেই ছিটকে গিয়েছিল ভারত। যদিও এবার পরিস্থিতি সমপূর্ণ ভিন্ন এবং টিম ইন্ডিয়া বিশ্বকাপ জয়ের তালিকায় শীর্ষ ফেভারিট।

ক্রিকেটের সর্বোচ্চ এ আসরটি এবার ভারত, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের হিসাবে এটি দশম আসর যাতে অংশ নিচ্ছে ১৪টি দল। ২০০৬ সালে বিশ্বকাপটির দায়িত্ব পাওয়ার সময় পাকিস্তানও ছিল এর অন্যতম যৌথ আয়োজক। কিন্তু ২০০৯ সালে পাকিস্তানের লাহোরে সফরকারী শ্রীলংকা দলকে বহনকারী বাসে সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালালে তাদের কাছ থেকে এ অধিকার কেড়ে নেয় ক্রিকেটের বিশ্বসংস্থা আইসিসি। ৪৯ ম্যাচের এ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ আটটি, ভারত ২৮টি ও শ্রীলংকা ১৩টি খেলা আয়োজন করবে।

এবারের বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করা দেশ ১৪টি দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রাউন্ড রবিনভিত্তিতে প্রাথমিক পর্বে অংশ নেবে। এর মানে প্রতিটি দল গ্রুপের অপর ছয়টি দলের সাথে বাধ্যতামূলকভাবে খেলবে। এ রাউন্ড শেষে প্রতি গ্রুপের শীর্ষ চারটি করে দল অংশ নেবে কোয়ার্টার ফাইনালে। গ্রুপ 'এ'তে আছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া, কেনিয়া, পাকিস্তান, কানাডা, গেলবারের রানার্স আপ শ্রীলংকা, জিম্বাবুয়ে ও নিউজিল্যান্ড। গ্রুপ 'বি'তে পড়েছে ভারত, বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

ভারতের মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপের ফাইনাল।

এদিকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে মনোমুগ্ধকর ও স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্বকাপের সাংগঠনিক কমিটি ও স্থানীয় আয়োজকরা চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। আজ বুধবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভেন্যু বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে চূড়ান্ত মহড়া। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে এ মহড়া শুরু হয়।

পাঁচ ভাগে বিভক্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আমন্ত্রিত অতিথিবর্গ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রবেশের পর বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে শুরু হবে মূল পর্ব। তার আগে অনুষ্ঠিত হবে ৫০ মিনিটের প্রাক উদ্বোধন পর্ব। এতে বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকার ৪ জন করে পুরুষ ও নারী কণ্ঠশিল্পী অংশ নেবেন। পর্বটি শুরু হবে বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মাঝখানে স্থাপিত সুসজ্জিত মঞ্চে স্থানীয় গায়ক ইবরার টিপু ও বালাম, মিলা, কণা ও এলিটা মিলে পরিবেশন করবেন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের স্বাগত সঙ্গীত। জুলফিকার রাসেল রচিত 'ও পৃথিবী এবার এসে.. বাংলাদেশ নাও চিনে, ও পৃথিবীঃ তোমায় স্বাগত জানাই এইদিনে..' গানটি গাইবেন তারা। এলিটা গাইবেন ইংরেজি অংশ। গানটিতে বাঁশি, বেহালা, তবলা, ঢোল, সানাইসহ ১৮টি অ্যাকুস্টিক বাজান ৪০ জন যন্ত্রশিল্পী।

স্বাগত সঙ্গীতের পর মাঠে প্রবেশ করবে বিশ্বকাপের মাসকাট স্টাম্পি। এর পেছনে বর্ণাঢ্য সাজে সজ্জিত 'লীড' নামক রিকশায় চড়ে ১৪টি দেশের অধিনায়কের নেতৃত্বে ক্রিকেট দলগুলোর প্রতিনিধিরা মার্চপাস্টে অংশ নেবেন।

কানাডার বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ব্রায়ান অ্যাডামস হবেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সকল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। অ্যাডামস ঢাকায় আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান 'এভরিথিং আই ডুঃ' পরিবেশন করবেন বলে জানা গেছে। নিজের সর্বশেষ অ্যালবাম 'বেয়ার বোনস' থেকেও গান পরিবেশনের সম্ভাবনা রয়েছে তার।

বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আলাদা তিনটি পর্বে ফুটিয়ে তোলা হবে ১৩৫ মিনিটের বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। বাসস জানায়, ভারতের তারকা শিল্পী ও কোরিওগ্রাফাররা 'সিম্পোনি অব কালারস,' শ্রীলংকার সেলিব্রেটি ইভেন্ট 'দি পার্ল অব ইন্ডিয়ান ওশান' এবং বাংলাদেশের 'দি রাইজিং টাইগার অব এশিয়া' নামে পর্ব তিনটি পরিবেশন করা হবে। বাংলাদেশের পর্বে রয়েছে ২০ মিনিটের অনুষ্ঠান। এছাড়া ভারত ১২ মিনিট ও শ্রীলংকা আট মিনিটের অনুষ্ঠান পরিবেশন করবে।

দেশবরেণ্য নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ ও শামীম আরা নিপা বাংলাদেশ পর্ব পরিচালনা করবেন। পর্বটিতে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও সেনা সদস্য মিলিয়ে ২ হাজার ১শ' জন কোরিওগ্রাফার অংশ নেবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মঞ্চের মাটি ফুঁড়ে 'রাখালের বাঁশির সুরে' উপরে উঠে আসবেন শিবলী মোহাম্মদ। বাঁশির সুর শেষেই বাংলাদেশের উপজাতি রাখাইন, সাঁওতাল, চাকমা ও মনিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশিত হবে। এ সময় ঢোল, বাঁশি, দোতরা ও লোকজ সুর বাজানো হবে।

এরপর মহান ২১ ফেব্রুয়ারির স্মরণে মাঠের চারদিক থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ঃ শেস্নাগানে উচ্চকিত হবে চারধার। তখন আবহে বাজবে ওরা আমার মুখের ভাষা ঃ কাইরা ঃ নিতে চায়। গানটি চলাকালে মাঠ জুড়ে আলোকচ্ছটা দিয়ে বাংলা বর্ণমালা ফুটিয়ে তুলবেন চীনা বিশেষজ্ঞরা। এক কিশোরের গলায় এরপর শোনা যাবে অমর গান-আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি, ঃ পরে একজন মা এ গানটি গাইবেন।

তৃতীয় পর্যায়ে ফুটিয়ে তোলা হবে একাত্তরের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনের মুহূর্তগুলো। আলো ও গোলাগুলির শব্দ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের এ আবহ তৈরি করা হবে।

একদল ছেলে-মেয়ে জয় বাংলাঃ শেস্ন্লাগান দিয়ে ছুটে যাবে। শুরু হবে জয়ঃ বাংলা ঃ বাংলার .. জয় .. গানটি। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, 'এ বারের সংগ্রাম ঃ স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রামে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম' বেজে উঠবে। বঙ্গবন্ধু যখন বলবেন জয় বাংলা ঃ তখন স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশের শিল্প ব্যাংকের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ৬০ ফুট পর্দায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অগি্নঝরা মুহূর্ত ফুটে উঠবে। শুরু হবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ৪০ সেকেন্ডের আলো ও শব্দের মাধ্যমে ঐতিহ্য চিত্র।

এরপর কবি নজরুলের 'কারার ওইঃ লৌহ কপাট ঃ' গান পরিবেশিত হবে। এক পর্যায়ে চারিদিক থেকে বিশাল আকৃতির ম্যাপসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের ৪টি পতাকা নিয়ে ছুটে আসবে মুক্তিযোদ্ধারা। একদিকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দ ফুটিয়ে তোলা হবে এবং অন্যদিকে দেশমাতৃকার প্রতি ভালবাসা মেলে ধরতে সঙ্গীত পরিবেশিত হবে 'ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা'। এ সময় মধ্যমঞ্চে ফুটে উঠবে শাপলা ফুল।

সব শেষে সুন্দরবনের গহীন বন ফুটিয়ে তোলার পর রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন ও থিম সঙ্গীতের মাধ্যমে আইসিসির পতাকা মেলে ধরা হবে। অতঃপর কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্রিকেট উপস্থাপন করে বাংলাদেশ পর্বের ইতি টানা হবে।

এর আগে শ্রীলংকার কোরিওগ্রাফার ও শিল্পীরা 'দি পার্ল অব ইন্ডিয়ান ওশান' পর্বের শুরুতেই আলোক রশ্মি ও শব্দের মাধ্যমে সাগরের ঢেউ ফুটিয়ে তুলবেন। মাঠ ও আকাশে ছড়িয়ে যাবে নীল রঙ। এক পর্যায়ে মধ্যমঞ্চে সুরের মূর্ছনায় ফুটিয়ে তোলা হবে মুক্তা। মুক্তাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবেন শ্রীলংকান একজন তারকা অভিনেত্রী।

ভারতের কোরিওগ্রাফার সন্তোষ শেঠজির পরিচালনায় সেদেশের কোরিওগ্রাফার ও শিল্পীরা পরিবেশন করবেন 'সিম্পোনি অব কালারস'। বার মিনিটের এ পর্বে ভারতের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরবেন শিল্পীরা।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শেষপর্বে আতশবাজি ও আলোক রশ্মির মায়াজালে ক্রিকেটামোদীদের আচ্ছন্ন করে দেবেন চীনা বিশেষজ্ঞরা।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে আলোর ঝর্নাধারায় ভাসিয়ে তুলতে তিন ধাপে বিভিন্ন স্থানে স্পট লাইট বসানো হয়েছে। রংবেরংয়ের লাল-নীল-সবুজ-হলুদ-সাদা, বেগুনি আলোর খেলা দর্শকদের বিমোহিত করবে।

অনুষ্ঠানটিতে বিশ্বকাপের অফিসিয়াল থিম সঙ্গীত 'জিতবে এবারঃ জিতবে ক্রিকেট' এবং হিন্দীতে 'দে ঘুমাকে.. ঘুমাকে (মার ঘুরিয়ে)' সঙ্গীত পরিবেশন করবেন ভারতের বিখ্যাত শিল্পী শংকর মহাদেভন। গানটি একই সঙ্গে হিন্দি ও সিংহলি ভাষায়ও পরিবেশিত হবে বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন। ক্রিকেটের বিশ্ব সংস্থা আইসিসি অনুষ্ঠানটির জন্য ভারতীয় প্রতিষ্ঠান উইজক্রাফটকে দায়িত্ব দিয়েছে।