আবার এসেছে ফিরে একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশ মানে মাথানত না করা। অধিকার আদায়ে আপসহীনভাবে এগিয়ে যাওয়া। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...।’ হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এ গানের করুণ সুরে আজ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখে যাবে লাখো মানুষের প্রভাতফেরির মিছিল। অমর একুশের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দিনের প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে ফুল নিয়ে অগণিত মিছিল যাওয়া শুরু হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।
আজ অমর একুশে। মহান শহীদ দিবস। শুধু বাংলাদেশে শহীদ দিবস নয়, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে। আজ থেকে ৫৯ বছর আগে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। বরকত, রফিক, সালাম, জব্বারসহ নাম না জানা বেশ ক’জন শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল; যার চূড়ান্ত রূপ হিসেবে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন তাই এদেশের রক্তঝরা প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এজন্য প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এ দিনটি একদিকে শোকাবহ, অন্যদিকে গৌরবোজ্জ্বল। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন শুধু এদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও নতুন চেতনা-প্রবাহ সৃষ্টি করেছিল। এই চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং ন্যায়বিচারের মূল্যবোধসঞ্জাত। এজন্যই ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথম একুশে পদক প্রবর্তন করেন। চার ক্যাটাগরিতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ড. কুদরাত-এ-খুদা, কবি জসীমউদ্দীন, কবি সুফিয়া কামাল, কবি আবদুল কাদির, অধ্যাপক মো. মনসুর উদ্দিন, সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল কালাম শামসুদ্দীন ও আবদুস সালাম প্রথম এ সম্মাননা পান।
আজ অমর একুশে উপলক্ষে দেশের সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, পুষ্পস্তবক অর্পণ, আজিমপুরে ভাষা শহীদদের কবর জিয়ারত, আলোচনা সভা, একুশের কবিতা পাঠের আসর এবং ভাষাসৈনিকদের অংশগ্রহণে একুশের স্মৃতিচারণ। দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় শহীদ মিনার ঘিরে একই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। কারণ, শহীদ মিনার মা ও সন্তানের প্রতীকস্তম্ভ।
মহান একুশে উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বাণী দিয়েছেন। সংবাদপত্রগুলো আজ এ উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। এসব ক্রোড়পত্রে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও কবিতায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে নতুন প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করা হয়। রেডিও-টেলিভিশন ও বেসরকারি চ্যানেলগুলো শহীদ দিবস উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। অমর একুশে উপলক্ষে বাংলা একাডেমীর বইমেলা চলছে। একুশের সংকলন প্রকাশ এ দিবসটির একটি উল্লেখযোগ্য দিক। সারাদেশেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে এ সংকলন প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী : মহান ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের শহীদদের অম্লান স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, অমর একুশে আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক।
বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাণী : বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এক বাণীতে ভাষা শহীদদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে এক তাত্পর্যময় দিন। দেশ স্বাধীন হলেও নতুন করে ভিন্নমাত্রায় আধিপত্যবাদী শক্তি এদেশের ওপর সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য কায়েম করতে চাচ্ছে। একুশের অম্লান চেতনায় সব ষড়যন্ত্রকারী, আন্তর্জাতিক আধিপত্য শক্তিকে রুখতে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আওয়ামী লীগ : সকাল সাড়ে ৬টায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সংগঠনের সব শাখা কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন এবং সকাল সাড়ে ৭টায় নিউমার্কেটের দক্ষিণ গেট থেকে নগ্নপায়ে কালোব্যাজ ধারণ করে প্রভাতফেরিসহ আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের কবর জিয়ারত, পুষ্পমাল্য অর্পণ ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোও একই ধরনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
বিএনপি : ভোরে দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং দলীয় ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ। ভোর ৬টায় বলাকা সিনেমা হলের সামনে থেকে কালোব্যাজ ধারণ ও প্রভাতফেরিসহ আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের কবর জিয়ারত, পুষ্পমাল্য অর্পণ ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন। এছাড়া বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের উদ্যোগে দেশব্যাপী জেলা ও থানা পর্যায়ে এ উপলক্ষে প্রভাতফেরি, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।