Saturday, February 19, 2011

সাংবিধানিক সঙ্কটের মুখোমুখি বাংলাদেশ

এক নজিরবিহীন অন্যরকম সাংবিধানিক সঙ্কটের মুখোমুখি বাংলাদেশ। বিশিষ্ট আইনবিদ ড. শাহদীন মালিক ১৬ই ফেব্রুয়ারি বৈশাখী টিভিতে প্রশ্ন তুলেছেন, পুনঃমুদ্রিত সংবিধান আদৌ কার্যকর কিনা। এর মানে হলো- এটিকে বাংলাদেশের সংবিধান বলা যাবে নাকি শুধুই সাদা কাগজের বাণ্ডিল? ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, সংসদের অনুমোদন ছাড়া এটা কার্যকর হবে না। এমনকি আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও সংসদে বলেছেন, আদালত সংবিধান সংশোধন করতে পারে না। সামরিক ফরমান দিয়ে করা পরিবর্তন বাতিল করতে পারে। তবে আইনমন্ত্রী বলেছেন, পুনঃমুদ্রিত সংবিধানই বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান, যা আপিল বিভাগের রায়দান থেকে কার্যকর। অন্যদিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, আমরা কি এটাকে খসড়া ধরে কাজ করবো। আর বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশ সংবিধান যে এখন একটি সাংঘর্ষিক অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু। আবার সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস তুলে দেয়া হলো। সেখানে বসেছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আবার বলা হলো, রাষ্ট্র কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দেবে না। কিছুদূর গিয়ে দেখা যাবে, সংবিধানই বলছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। আবার সংবিধানই বলছে, ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি করার অধিকার কারও থাকবে না। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কোন দল নিষিদ্ধ হবে না। সব মিলিয়ে এরকম একটি জগাখিচুড়ি অবস্থা তৈরি হয়ে আছে। তবে সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আশ্বস্ত করেছেন, তারা শিগগিরই সংবিধান সংশোধন বিল আনবেন।
পুনঃমুদ্রিত সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও তৎপরতা নিষিদ্ধ থাকা সংক্রান্ত শর্তাংশ পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাসহ পুনঃস্থাপিত হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তবে পাসপোর্ট ও অন্যান্য নথিপত্র সংশোধনের ঝক্কি-ঝামেলা ও মানুষের দুর্ভোগের কারণ দেখিয়ে নাগরিকত্বের পরিচয় ‘বাংলাদেশী’ রাখা হয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, বাংলাদেশের নাগরিকরা বাঙালি বলে পরিচিত হবেন। হাইকোর্ট এটাই পুনর্বহাল করেন। কিন্তু আপিল বিভাগ ‘বাংলাদেশী’ পরিচয় সমুন্নত রাখে। পুনঃমুদ্রিত সংবিধানেও তাই রাখা হয়েছে।
বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৫ সালের ২৯শে আগস্ট পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এর বিরুদ্ধে বিএনপি সমপ্রতি লিভ টু আপিল (আপিল অনুমতির আবেদন) করে। আপিল বিভাগ গত বছরের ২রা ফেব্রুয়ারি তা খারিজ করে। আপিল বিভাগের ১৮৪ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত রায় লিখেছেন বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম। আপিল বিভাগের অপর পাঁচ বিচারক বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম, বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, বিচারপতি বিজন কুমার দাস, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি এসকে সিনহা রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। কেউ আলাদাভাবে কোন পর্যবেক্ষণ দেননি। তারা গত ২৭শে জুলাই, ২০১০ পূর্ণাঙ্গ রায়ে সই করেন। এরপর আইন মন্ত্রণালয় আমলাদের দিয়ে একটি কমিটি করে। সংসদে একটি বিশেষ কমিটি হয়। কিন্তু সেই কমিটির সামনে পুনঃমুদ্রিত সংবিধান পেশ করা হয়নি বলে জানা যায়। লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং উইংয়ের আমলা কমিটি এটি পাস করেছে।
ধর্মের প্রশ্ন: বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মসংক্রান্ত কয়েকটি বিধান ছিল। পঞ্চম সংশোধনীতে তা বিলোপ করা হয়। হাইকোর্টের রায়ে বিসমিল্লাহ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। আইনমন্ত্রী মনে করেন, এটি সংবিধানের অংশ নয়। আপিল বিভাগের রায়েও এ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ১৬ই ফেব্রুয়ারি আরটিভিতে বলেন, বিসমিল্লাহ যেখানে লেখা সেটি সংবিধানের অংশ নয়। পঞ্চম সংশোধনীতে ১২ অনুচ্ছেদটি পুরোপুরি বিলোপ করা হয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত সংবিধানে  ১২ অনুচ্ছেদটি অনুপস্থিত। শুধু লেখা ছিল ‘বিলুপ্ত’। মূল অনুচ্ছেদে লেখা ছিল সব ধরনের সামপ্রদায়িকতা, রাষ্ট্র দ্বারা কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, ধর্মের অপব্যবহার ও ধর্ম পালনের কারণে ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বিলোপ করা হবে। এখন ১২ অনুচ্ছেদ ফিরে এলো। তবে এই অনুচ্ছেদটি এখন রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিভাগে। তাই এর কোন লঙ্ঘন ঘটলে তা আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হবে না। কিন্তু ৩৮ অনুচ্ছেদের বিলুপ্ত অংশ ফিরে আসায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কার্যত নিষিদ্ধ হবে। পঞ্চম সংশোধনীতে এটিও বিলোপ করা হয়। ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করা বা তার সদস্য হওয়ার বা অন্য কোন প্রকারে তার তৎপরতায় অংশ নেয়ার অধিকার কোন নাগরিকের থাকবে না।
প্রস্তাবনা: মূল সংবিধানের  প্রস্তাবনায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির অংশগ্রহণকে ‘জাতীয় মুক্তি’ ও জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের লক্ষ্যে পরিচালিত বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীতে জাতীয় মুক্তি ও জাতীয় মুক্তি-সংগ্রাম মুছে ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়। এখন আবার আগের অবস্থা ফিরে এলো। জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও প্রাণোৎসর্গের চেতনা ছিল চারটি। এগুলো সংবিধানের মূলনীতি। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। পঞ্চম সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেয়া হয়। সমাজতন্ত্র শব্দটি রেখে একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়। বলা হয়, সমাজতন্ত্র মানে হবে- অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার। আর নতুন করে এখানে যোগ করা হয়, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, এখন তা থাকবে না। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাই  হবে বাংলাদেশ সংবিধানের চার মূলনীতি। পুনঃমুদ্রিত সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে এই চার মূলনীতি ফিরে এলো। এই চার মূলনীতি হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলসূত্র। এমনকি আইন ও সংবিধান ব্যাখ্যারও সূত্র হবে এই চারটি বিষয়। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীতে এই অনুচ্ছেদটিতেও পরিবর্তন আনা হয়। বলা হয়, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস হবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি। এখন এটিও আর থাকলো না।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ: বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিল জাতীয়তাবাদ। ‘ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।’ এটি অবিকল ফিরে এলো। পঞ্চম সংশোধনীতে এটি সম্পূর্ণ বিলোপ করা হয়েছিল। বসানো হয়েছিল একটি নতুন অনুচ্ছেদ। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সঙ্গে একমত হন যে, বিদ্যমান অনুচ্ছেদটি থাকা নিরর্থক। সেখানে বলা ছিল, ‘স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহ দান এবং এতে কৃষক, শ্রমিক ও নারীদের বিশেষ প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হইবে।’ বাহাত্তরের সংবিধানে ১০ অনুচ্ছেদটি বিলোপ করা হয়েছিল। এখন এটি ফিরে এলো; যেখানে বলা আছে, ‘মানুষের ওপর মানুষের শোধন হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’ পঞ্চম সংশোধনীতে লেখা হয়েছিল, ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’
পররাষ্ট্র: আগের ২৫ অনুচ্ছেদ থেকে একথা লুপ্ত করা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ ও জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।’ জিয়া বিধান করেছিলেন, বিদেশের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি সংসদে ফেম করতে হবে। কিন্তু সে বিধানটিও পুনঃমুদ্রিত সংবিধানে বাদ পড়েছে।
গণভোট: বাহাত্তরের সংবিধানে সংবিধান সংশোধনের জন্য কোন গণভোটের বিধান ছিল না। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধানের যে কোন অনুচ্ছেদ পরিবর্তন বা সংশোধন করার পথ খোলা ছিল। পঞ্চম সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, সংবিধানের প্রস্তাবনার অথবা ৮, ৪৮, ৫৬, ৫৮, ৮০, ৯২ক অনুচ্ছেদ অথবা ১৪২ অনুচ্ছেদের কোন বিধানাবলীর সংশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে, এমন বিল পাসে সংসদ যথেষ্ট নয়। তাকে তা গণভোটে পাস করাতে হবে। ’৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীতে ৯২ক বিলুপ্ত হয় এবং ১৪২ অনুচ্ছেদে নতুন বিধান করা হয় যে, ‘প্রস্তাবনা ৮, ৪৮, ৫৬ ও ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হলে গণভোট লাগবে।’ দ্বাদশ সংশোধনীতে তা পাস হয়। তবে এখন তা বিলুপ্ত হলো। যে কোন সংবিধান সংশোধন বিল পাস করাতে এখন থেকে গণভোট করতে হবে না।
উল্লেখ্য, পঁচাত্তরের ২০শে আগস্ট থেকে ’৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর পর্যন্ত যা কিছু ফরমান, বিধি জারি ও কাজ করা হয়েছে, তাকে ঢালাও বৈধতা দেয়া হয় এবং সে জন্য ওই তফসিলে ৩ক যুক্ত করা হয়। এখানেই বলা আছে, সামরিক আইনে যা কিছুই করা হোক না কেন, কোন আদালতে তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল, এর কোন আইনগত ভিত্তি নেই। এ ধরনের বাক্য সংযোজন সংসদের এখতিয়ার বহির্ভূত। আপিল বিভাগ বলেছে, একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমেও এই তফসিলে নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং হাইকোর্টের এ সংক্রান্ত যাবতীয় পর্যবেক্ষণ অপ্রয়োজনীয়। সে কারণে তা হাইকোর্টের রায়ের অংশ নয় বলে ঘোষণা করা হলো। কিন্তু পুনঃমুদ্রিত সংবিধানে আপিল বিভাগের দোহাই দিয়েই ওই ৩ক বিলোপ করা হয়েছে। এছাড়া অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ১১৬ অনুচ্ছেদ থেকে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শের বিধান তুলে দিয়েছে। অথচা হাইকোর্ট বা আপিল বিভাগ তা তুলে দিতে বলেনি। এর ফলে নিম্নআদালতের বিচারকদের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো। আইন বিশ্লেষকরা বলেছেন, আদালত কর্তৃক মার্জনা করা হয়েছে- এমন বহু ক্ষেত্রে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আনা পরিবর্তন বিলুপ্ত করা হয়েছে।